• বুধবার ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪
logo

রুপালি গিটারেই যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন আইয়ুব বাচ্চু

নিজস্ব প্রতিবেদক ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ০৩:৩২ পিএম

রুপালি গিটারেই যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন আইয়ুব বাচ্চু

‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি, তাই তোমার কাছে ছুটে আসি।’ অনেকেই হয়তো বারবার শুনে থাকেন এই গানটি। বিশেষ করে নব্বই দশকে যাদের শৈশব কেটেছে তারা এই গান গুন গুন করে নস্টালজিয়ায় ভোগেন। ভোগারই কথা। সেসময়ের একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে আইয়ুব বাচ্চুতে বুঁদ থেকে। আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যু একটা প্রজন্মের স্মৃতির মৃত্যু ঘটিয়ে দিয়েছিল।

বাচ্চুর গান শুনে শুনে বেড়ে ওঠা তরুণ-তরুণীরা এখন জীবনের মধ্য পর্যায়ে। এই সময়ের একটা বড় প্রবণতা স্মৃতিকাতর হয়ে শৈশবকে দেখা। কিন্তু শৈশবের সেই কণ্ঠশিল্পীর কথা মনে পড়তেই ঝাপসা হয়ে আসে এই প্রজন্মের মানুষের চোখ। কারণ কষ্ট পেতে চাওয়া একটা প্রজন্ম হারিয়ে ফেলেছে তাদের হৃদয়ের সুরের জাদুকরকে। হারিয়ে ফেলেছে সেই মানুষটিকে যিনি আর বলবেন না ‘বহুদূর যেতে হবে, এখনো পথের অনেক রয়েছে বাকি, ভালোবাসায় বিশ্বাস রেখো হয়তো অচেনা মনে হতে পারে আমাকে-তুমি ভয় পেয়ো না, তুমি থেমে যেও না।’ সেই অভয় ছাড়া কীভাবে চলবে এই প্রজন্ম! ২০১৮ সালে হারিয়ে যাওয়া সেই সুরের জাদুকর, রূপালি গিটারওয়ালাকে নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন। ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর পরপারে পাড়ি জমান তিনি। 

সংগীত জগতে তার বিচরণ শুরু ১৯৭৮ সালে। ফিলিংস ব্যান্ডের হয়ে। তার কণ্ঠ দেওয়া প্রথম গান ‘হারানো বিকেলের গল্প’। এরপর যোগ দেন সোলসে। পুরো এক দশক এই ব্যান্ডের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন বাচ্চু। এর মধ্যে প্রকাশিত হয় তার দুটি একক অ্যালবাম।

১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’ (১৯৮৬)। এটা সত্য যে তুমুল জনপ্রিয় এই কণ্ঠশিল্পীর এই প্রথম অ্যালবামটি সাড়া ফেলতে পারেনি। তবে দমে যাননি বাচ্চু। পরের অ্যালবামেই বাজিমাত করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়না’ (১৯৮৮)। এটি ব্যাপক সাড়া ফেললে বাচ্চুকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

১৯৯১ সালে বাচ্চু এলআরবি ব্যান্ড গঠন করেন। প্রথমে এলআরবির পূর্ণ অর্থ ছিল লিটল রবিনস ব্যান্ড। পরে এই নাম বদলে করা হয় লাভ রানস ব্লাইন্ড। এই ব্যান্ডের সঙ্গে তার প্রথম ব্যান্ড অ্যালবাম ‘এলআরবি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। এটি বাংলাদেশের প্রথম দ্বৈত অ্যালবাম। এই অ্যালবামের ‘শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি’, ‘ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘হকার’ গানগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে।

১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় আইয়ুব বাচ্চুর একক অ্যালবাম সুখ। ‘সুখ’, ‘চলো বদলে যাই’, ‘রুপালি গিটার’, ‘গতকাল রাতে’ গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বলতে গেলে সুখ অ্যালবামের ‘চলো বদলে যাই’ গানটি গত দুই যুগ ধরেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে রয়েছে। এই গানটির কথা লিখেছেন ও সুর করেছেন এবি নিজেই।

এরপর একে বের হয় এলআরবি ব্যান্ডের অ্যালবাম ‘তবুও’ (১৯৯৪), ‘ঘুমন্ত শহরে’ (১৯৯৫), ‘ফেরারি মন’ (১৯৯৬), ‘স্বপ্ন’ (১৯৯৬), ‘আমাদের বিস্ময়’ (১৯৯৮), ‘মন চাইলে মন পাবে’ (২০০০), ‘অচেনা জীবন’ (২০০৩), ‘মনে আছে নাকি নেই’ (২০০৫), ‘স্পর্শ’ (২০০৮), ‘যুদ্ধ (২০১২),

আইয়ুব বাচ্চুর একক অ্যালবামগুলো হচ্ছে- ‘রক্তগোলাপ’ (১৯৮৬), ‘ময়না’ (১৯৮৮), ‘কষ্ট’ (১৯৯৫), ‘সময়’ (১৯৯৮), ‘একা’ (১৯৯৯), ‘প্রেম তুমি কি!’ (২০০২), ‘দুটি মন’ (২০০২), ‘কাফেলা’ (২০০২), ‘প্রেম প্রেমের মতো’ (২০০৩), ‘পথের গান’ (২০০৪), ‘ভাটির টানে মাটির গানে’ (২০০৬), ‘জীবন’ (২০০৬), ‘সাউন্ড অব সাইলেন্স’ (ইন্সট্রুমেন্টাল, ২০০৭), ‘রিমঝিম বৃষ্টি’ (২০০৮), ‘বলিনি কখনো’ (২০০৯), ‘জীবনের গল্প’ (২০১৫)।

“এখন অনেক রাত/খোলা আকাশের নীচে/জীবনের অনেক আয়োজন/আমায় ডেকেছে/তাই আমি বসে আছি/দরজার ওপাশে’’ জীবনের অনেক আয়োজনে মগ্ন তরুণ এভাবেই রাতভর খোলা আকাশের নীচে বসে বসে আইয়ুব বাচ্চুর গান শুনেছেন। সেই গানে মত্ত পাগল হয়ে তরুণটি হয়তো কখনো সত্যি সত্যি প্রেমিকার বাড়ির চৌকাঠ থেকেও ফিরে এসেছেন চুপি চুপি। কিন্তু হায়, হারানো প্রেমিকার হাসিমুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কান্নাও দেখে ফেলে জীবনের অন্য আয়োজনে- সুখেরই পৃথিবী/সুখেরই অভিনয়/যত আড়ালে রাখো/আসলে কেউ সুখী নয়/নিজ ভুবনে চিরদুঃখী/আসলে কেউ সুখী নয়’’ নিজ ভুবনের দুঃখ নিয়ে, প্রেম-বিরহ-বিচ্ছেদ অথবা প্রেমিকার স্পর্শের সুখ নিয়ে তরুণ প্রজন্ম ফিরে গেছে আইয়ুব বাচ্চুর কাছেই। কী সুখে, কী বিরহে, কী দুঃখে- তরুণ-তরুণীরা বিশেষ সময়ে গুনগুন করে আইয়ুব বাচ্চুর গানেই নিজের মুহূর্তটুকু নানা রঙে রাঙিয়ে তুলত।

তার বিখ্যাত গান ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে/সেই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম/কেমন করে এত অচেনা হলে তুমি/কীভাবে এত বদলে গেছি এই আমি/ও বুকের সব কষ্ট দুহাতে সরিয়ে/চলো বদলে যাই...’’ এই গানটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে, তার সুখ অ্যালবামে। গানটি প্রকাশের পর থেকে আজ অব্দি তা সব প্রজন্মের কাছে প্রিয়। ২৫ বছর আগে জন্ম নেয়া এই গানটি এ দেশের সঙ্গীতশিল্পেরও অন্যতম সেরা সৃষ্টি। এ গানটি শুধু গাননি, এটির গীতিকারও ছিলেন এবি। জানা যায়, মালিবাগের একটি বাড়িতে বসে একটানে লিখে ফেলেছিলেন ‘সেই তুমি’ গানটি।

আইয়ুব বাচ্চুর গান শোনা শুরু হয় আশির দশকে। ২০ টাকার ক্যাসেট কিনে যে গায়কের গানে একসময় মুগ্ধ হতো শ্রোতা। ক্যাসেট, সিডি–এমপিথ্রির যুগ পেরিয়ে ইউটিউব প্রজন্মের কাছেও জনপ্রিয় সেই গায়ক, সেই গানওয়ালার গান। ভাবা যায়!

প্রেম বিরহের ব্যথা কাতর হয়ে এখন আর কেইবা বলবে ‘আমার একটা নির্ঘুম রাত তোমার হাতেই তুলে দিলেই বুঝতে তুমি কষ্ট কাকে বলে’। এসব নানামাত্রিক কথায়, সুরে মুগ্ধ হয়েছে নব্বইয়ের সেই প্রজন্ম। আজো, আজকের প্রজন্মও সেই সব গানে কখনো কখনো বুঁদ হয়ে থাকে। অবাক করার মতো বিষয় যে, প্রায় দুই যুগের বেশি সময় ধরে দুই তিন প্রজন্মের প্রিয় শিল্পী হয়ে বসে আছেন আইয়ুব বাচ্চু।

অথচ ‘‘এই রুপালি গিটার ফেলে/একদিন চলে যাব দূরে, বহু দূরে/সেদিন চোখের অশ্রু তুমি রেখো গোপন করে...গান পাগল প্রজন্ম কী করে সেই অশ্রু গোপন করে? করতে পারে না। তাই ২০১৮ সালের ১৮ই অক্টোবর থেকে সংগীত জগতে বয়ে চলছে অশ্রুবৃষ্টি।