কিম কি দুক। বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক জনপ্রিয় নাম। রূপালি পর্দায় গল্প বলে তিনি জয় করে নিয়েছেন মানুষের হৃদয়। এই অসাধারণ শিল্প স্রষ্টা ২০২০ সালের ১১ ডিসেম্বর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। প্রয়াণ দিবসে চলুন জেনে নিই, কিম কি দুক সম্পর্কে-
১৯৬০ সালের ২০শে ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার বোংঘোয়ায় জন্মগ্রহণ করেন কিম কি দুক। আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না কিম কি দুকের। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই নেমে পড়তে হয় জীবিকার সন্ধানে। একটি কারখানায় কাজ শুরু করেন। ২০ থেকে ২৫ বছরের সময়টা তার কেটেছে মিলিটারিতে। কিম কি দুকের বয়স যখন ৩০ তখন তিনি অবসর পান নিজের শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করার। ১৯৯০ সালে নিজের জমানো টাকা নিয়ে পাড়ি জমান ফ্রান্সে। আর ফ্রান্সে এসেই জীবনে প্রথমবারের মতো সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেন কিম কি দুক। আর এই প্রবাসেই তিনি ছবি এঁকে তা রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে বেড়াতেন। সেই টাকায় চলত তার একার সংসার।
১৯৯০ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি পড়াশোনা করেন ফাইন আর্টস নিয়ে। রং তুলির আঁচড়ে জীবনের ক্যানভাস আঁকতে আঁকতেই কিম কি দুক পাড়ি জমান চলচ্চিত্রের সচল ক্যানভাসে। এরপর কিম কি দুক নিজ দেশে এসে সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন।
‘A Painter and A Criminal Condemned to Death’ চিত্রনাট্যের জন্য কোরিয়ান ফিল্ম কাউন্সিল কর্তৃক আয়োজিত এক প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পান ১৯৯৫ সালে। চিত্রনাট্য লিখতে লিখতেই তার মনে চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছাও ভর করে। ১৯৯৬ সালে কিম নির্মাণ করলেন তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘ক্রোকোডাইল’ । খুব অল্প বাজেটে কিম তুলে ধরলেন মানুষের অন্তহীন না বলা গল্প। এতো অল্প বাজেটেও যে অদ্ভুত সুন্দর ফ্রেম তুলে ধরা যায় সেটা দেখিয়ে দিলেন কিম। এরপর ১৯৯৭ সালে নির্মাণ করলেন দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘ওয়াইল্ড এনিমেলস’, উঠে আসলো এই চলচ্চিত্রে প্যারিসের গল্প, প্যারিসের রাস্তা, চিত্রশিল্পের গল্প।
তখনো কিম আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাননি। কিমের প্রথম আন্তর্জাতিক খ্যাতি আসে ‘দ্য আইল’ সিনেমার মাধ্যমে। এরপর ২০০৩ সালে নির্মিত তার ‘স্প্রিং-সামার-ফল-উইন্টার’চলচ্চিত্রটি বিশ্ব নন্দিত হয়। এখন পর্যন্ত কিমের নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় চলচ্চিত্র এটিই। এই চলচ্চিত্রে কিম স্প্রিং-সামার-ফল-উইন্টার চারটি ঋতুকে মানুষের জীবনের চারটি সময়ের সাথে কাব্যিক বিশ্লেষণ করেছেন । দেখিয়েছেন শহর থেকে অনেক দূরের একটি হ্রদে ভাসমান বৌদ্ধ মন্দিরকে কেন্দ্র করে এক সন্ন্যাসীর জীবন ও দীক্ষা নিতে আসা এক বালকের গল্প। কিম দেখিয়েছেন দীক্ষা নিতে আসা সেই বালকের প্রতিবন্ধকতা, সীমাবদ্ধতাগুলো? তিনি দেখিয়েছেন কেউ চাইলেই নিজের মতো করে নিজের জীবন চালাতে পারে না, নিজের মতো একটা জীবন চালাতে গেলে অন্যকেও সমস্যায় পরতে হয়।
কিম কি দুকের চলচ্চিত্রগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, তিনি একেক চলচ্চিত্রে একেক ধরনের জীবনের গল্প বলেছেন। তার এই ভিন্নধর্মীতাই তাকে বিশ্ব দরবারে আরও স্বাতন্ত্র করে তুলেছে।
২০০৪ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘৩ আয়রন’। আয়রনের গল্পে তিন চোরের চোখে ধরা পড়ে এক নির্যাতিত নারীর কাহিনি। ২০০৫ সালে নির্মিত ‘The Bow’ ছবির গল্পে উঠে আসে এক ষোল বছরের মেয়ের সাথে ষাট বছরের এক বৃদ্ধের অন্যরকম এক ভালোবাসার গল্প।
নিজ দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় ও ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ৩-আয়রন চলচ্চিত্রের জন্য তিনি সেরা পরিচালকের সম্মানে ভূষিত হন এবং সামারিটান গার্ল চলচ্চিত্রের জন্য ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালকের পুরস্কার পান । ‘পিয়েটা’ নামক তার চলচ্চিত্রটি ২০১২ সালে বার্লিন ও কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার লাভ করে এবং গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার লাভ করে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে। এ যাবত তিনি ২০টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, পেয়েছেন আটচল্লিশটি পুরস্কার।