বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতি হলো অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী ও প্রীতির বন্ধনে সবাইকে আবদ্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। শুধু বৌদ্ধ ধর্মে নয়, অন্যান্য ধর্মেও এ নীতির কথা বলা হয়েছে। গৌতম বুদ্ধের মতে, জগৎ দুঃখময়, দুঃখের কারণ দূর করতে পারলেই নির্বাণ লাভ করা সম্ভব। কামনা, বাসনা থেকেই দুঃখ আসে। তাই কোনো কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা দূর করতে পারলে তথা, অজ্ঞানতার হাত থেকে মুক্তি পেলেই নির্বাণ লাভ সম্ভব।
নির্বাণ লাভের উপায়
আর্যসত্য তথা আর্য-অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলনই নির্বাণ লাভের শ্রেষ্ঠ উপায়। আর্যসত্য বা শ্রেষ্ঠসত্য হচ্ছে বুদ্ধবাণীর মূলতত্ত্ব। আর্যসত্য চার প্রকার: দুঃখ, দুঃখ সমুদয়, দুঃখ নিরোধ ও দুঃখ নিরোধের উপায়।
দুঃখ: সংসার চক্রের আবর্তনে পুনঃপুন জন্ম-মৃত্যু এবং তজ্জনিত দুঃখই প্রথম আর্যসত্য। দুঃখ বহু প্রকার: জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু, শোক, পরিতাপ, দুর্মনতা, অপ্রিয় সংযোগ, প্রিয়বিয়োগ, ঈষ্পিত বস্তুর অপ্রাপ্তি অর্থাৎ ‘যা চাই তা পাই না, যা চাই না তা পাই। সংক্ষেপে পঞ্চ উপাদান স্কন্ধই দুঃখ।
দুঃখ সমুদয়: দুঃখ সমুদয় হচ্ছে দুঃখের কারণ বা হেতু। তৃষ্ণাই পুনর্জন্মের হেতু। তৃষ্ণা তিন প্রকার: কাম (ভোগ) তৃষ্ণা, ভবতৃষ্ণা ও বিভবতৃষ্ণা। ইন্দ্রিয়ের প্রিয় বস্তুই কাম। ঐ বিষয়ের সাথে সম্পর্ক এবং মননই তৃষ্ণার জনক ‘ভব’ অর্থে উৎপত্তি, পুনর্জন্ম, জীবনও বোঝায়। ‘বিভব’ বলতে তৃষ্ণার নিবৃত্তিকে বোঝায়, যাকে আর জন্মগ্রহণ করতে হয় না।
দুঃখ নিরোধ: তৃষ্ণার নিরোধ বা ধ্বংসই দুঃখনিরোধ। প্রিয় বিষয় এবং তদ্বিষয় বিচার বিশ্লেষণ দ্বারা যখন তৃষ্ণা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়, তখনই দুঃখ নিরোধ হয়। দুঃখ নিরোধের অপর নাম হচ্ছে নির্বাণ।
দুঃখ নিরোধের উপায়: দুঃখ নিরোধের উপায় হচ্ছে আর্য-অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এই পথ অনুসরণ করতে হলে আট প্রকার কর্মপদ্ধতি বা নিয়মাবলী অনুসরণ করা প্রয়োজন। এই পথকেই বৌদ্ধ দর্শনে মধ্যপথ বলা হয়েছে। কারণ এই পথ একাধারে অসংযত ভোগবিলাস ও অপরদিকে অনাবশ্যক শারীরিক কৃচ্ছসাধন-এই চরম পথের মধ্যবর্তী পন্থা। অসংযত ভোগবিলাসের পথ হল হীন, অসম্মানজনক, আধ্যাত্মিকতা বর্জিত, ইতরভোগজন্য ও ঘৃণ্য। আবার অনাবশ্যক শারীরিক কৃচ্ছসাধনের পথ হল দুঃখময়, অনর্থ-সংযুক্ত ও অবাস্তব। তাই বুদ্ধদেব দুঃখমুক্তির জন্য চরমপন্থা ত্যাগ করে মধ্যপন্থা অবলম্বনের কথা বলেছেন। এই পথ সাধনের সহজ পথ। এই সাধনায় অসংযত ইন্দ্রিয় সম্ভোগও নেই, আবার অনাবশ্যক কৃচ্ছসাধনও নেই।
এতে আছে সংযম, চিত্তের একাগ্রতা, সকল রকম পাপকর্ম ও অসদাচার থেকে বিরত থেকে সদকর্মের অনুষ্ঠান। এ ছাড়া আছে মৈত্রী বা সার্বজনীন হিতকামনা, করুণা বা দুঃখীর প্রতি দয়া, মুদিতা বা অপরের সুখে আনন্দবোধ এবং উপেক্ষা অর্থাৎ আপরের দোষের প্রতি উদাসীনতা।