• বুধবার ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪
logo

নিসর্গ আর মানুষের কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী

সুদীপ্ত সাইদ খান ২৭ নভেম্বর, ২০২৪ ০৬:২৭ এএম

কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর এরকম অসংখ্য কালজয়ী সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যকে করে তুলেছে সুমহান।

‌‌''পায়ের তলায় নরম ঠেকল কী !/ আস্তে একটু চল্ না ঠাকুর-ঝি/ ওমা, এ যে ঝরা-বকুল। নয়?” এই কবিতাটি শৈশবে পড়েননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দূরুহ। নিঃসঙ্গ অন্ধ গ্রাম্য বধূর বেদনা কোনও কবি এ ভাবে ব্যক্ত করতে পারেন, ভেবে আশ্চর্য হতে হয়। 

এবার পড়া যাক কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর আরেকটি কবিতা- ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই’

এই কবিতা পড়ে চোখের জল ফেলেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কি বাংলাদেশ, কি ওপার বাংলা- বাংলা ভাষাভাষী যেখানে আছেন যে দেশেই আছেন কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর এই কালজয়ী কবিতা পড়েননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এই কবিতা পড়ে কতদিন চোখের জল ঝরিয়েছি তার কোন ইয়াত্তা নেই। বোন হারানোর বেদনা কুড়ে কুড়ে খেয়েছে আমাদের অন্তর। প্রিয়জন হারানোর বেদনা যে কতটা গভীর কতটা মর্মাহত তা এই কবিতা পড়ে সকলেই অনুধাবন করতে পেরেছেন।

কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর এরকম অসংখ্য কালজয়ী সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যকে করে তুলেছে সুমহান। প্রিয় পাঠক আজ আমরা ‘কীর্তিমান’ এর এই বিভাগে কথা বলব কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীকে নিয়ে। চলুন জেনে নেওয়া যাক তার সম্পর্কে-

যতীন্দ্রমোহন বাগচী ছিলেন একজন বাঙালি কবি ও সম্পাদক। তিনি নদিয়া জেলার জমশেরপুরে জমিদার পরিবারে ১৮৭৮ সালের ২৭ নভেম্বর জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস হুগলি জেলার বলাগড় গ্রামে। বাবার নাম হরিমোহন বাগচী ও মায়ের নাম গিরিশমোহিনী দেবী। বাড়িতে জ্যাঠামশাইয়ের কাছে রামায়ণ ও মহাভারত পাঠের মধ্য দিয়ে যতীন্দ্রমোহনের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। এরপর তিনি ভর্তি হন বহরমপুর খাগড়া মিশনারি স্কুলে।

অসম্ভব মেধাবী যতীন্দ্রমোহন অল্পবয়সেই তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণে শিক্ষকদের অবাক করে দেন। তিনি খাগড়া মিশনারি স্কুল বহরমপুর থেকে বৃত্তি নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৯৮ সালে কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন। সেই একই বছর ভাবিনীদেবীকে বিয়ে করার মাধ্যমে তিনি বৈবাহিক জীবন শুরু করেন। বিয়ের পর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০০ সালে এফএ এবং ১৯০২ সালে ডাফ কলেজ (বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ)  থেকে বিএ পাস করেন।

যতীন্দ্রমোহন ব্যক্তিগত সচিবরূপে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে কলকাতা করপোরেশনে নাটোর মহারাজের ব্যক্তিগত সচিব ও জমিদারির সুপারিনটেনডেন্ট পদে এবং কর কোম্পানি ও এফএন গুপ্ত কোম্পানির ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেন।

যতীন্দ্রমোহন বহু সাহিত্য পত্রিকায় গঠনমূলক অবদান রেখেছেন। ১৯০৯ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত মানসী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯২১ ও ১৯২২ সালে তিনি যমুনা পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।

১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ পূর্বাচল পত্রিকার মালিক এবং সম্পাদক ছিলেন। পল্লী-প্রীতি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিমানসের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। গ্রামবাংলার শ্যামল স্নিগ্ধ রূপ উন্মোচনে তিনি প্রয়াসী হয়েছেন। গ্রামজীবনের অতি সাধারণ বিষয় ও সুখ-দুঃখ তিনি সহজ সরল ভাষায় সহৃদয়তার সঙ্গে তাৎপর্যমণ্ডিত করে প্রকাশ করেছেন।

যতীন্দ্রমোহন ছিলেন রবীন্দ্রোত্তর যুগের শক্তিমান কবিদের অন্যতম। পল্লিপ্রকৃতির সৌন্দর্য ও পল্লিজীবনের সুখ-দুঃখের কথা তিনি দক্ষতার সঙ্গে প্রকাশ করেন। ভাগ্যবিড়ম্বিত ও নিপীড়িত নারীদের কথা তিনি বিশেষ দরদের সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। ‘কাজলাদিদি’ ও ‘অন্ধবন্ধু’ তাঁর এ ধরনের দুটি বিখ্যাত কবিতা।

তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো—লেখা (১৯০৬), রেখা (১৯১০), অপরাজিতা (১৯১৫), নাগকেশর (১৯১৭), জাগরণী (১৯২২), নীহারিকা (১৯২৭), মহাভারতী (১৯৩৬) ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ ও যুগসাহিত্য তাঁর একটি বিশেষ গদ্যগ্রন্থ।

১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।