বাংলা চলচ্চিত্রে শোষিত শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে বহুল পরিচিত মুখ সৈয়দ আখতার আলী। চারু ও কারুকলায় ডিপ্লোমাধারী সৃজনশীল এ মানুষটি অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার আঁকা ছবির চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে। চলচ্চিত্রে সহকারী চিত্রপরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছেন। এমনকি 'নাবালক' নামে অসমাপ্ত একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন তিনি। এতো সবকিছুর ভিড় ছাপিয়ে অভিনেতা হিসেবেই থিতু হয়ে পেয়েছেন জনপ্রিয়তা।
ভারতের আসামের ধুবড়ীতে এই কীর্তিমানের জন্ম ১৯৪১ সালের ১৭ অক্টোবর। অভিনয়ের নেশা থেকেই চলচ্চিত্রে আসেন। সাদেক খানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘নদী ও নারী’তে তার অভিষেক হয় । এছাড়া সৈয়দ আখতার আলী অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে- সূর্যদীঘল বাড়ি, সারেং বউ, কি যে করি, নাজমা, ফেরারী বসন্ত, সুরুজ মিঞা, দহন, এখনই সময়, নাগ পূর্ণিমা, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, মাটির ঘর, সন্ত্রাস, মায়ের দোয়া, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, পাপী শত্রু, আখেরি মোকাবেলা, টাইগার, বেদের মেয়ে জোসনা, ভাইজান, লালু মাস্তান, বিদ্রোহী বধূ, বুকের ভিতর আগুন, মায়ের অধিকার, তোমাকে চাই, স্বপ্নের নায়ক, স্বপ্নের ঠিকানা, মহামিলন, এই ঘর এই সংসার, বিচার হবে, সুজন সখি, প্রেমযুদ্ধ, আঞ্জুমান, শুধু তুমি, কুলি, সাবধান, চার সতীনের ঘর, আক্কেল আলীর নির্বাচন, মেঘের পরে মেঘ ও চিত্রা নদীর পারে।
চলচ্চিত্রের খুবই গুরুত্বপূর্ণ কোনো চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাননি গুণী এ অভিনেতা। কিন্তু অসংখ্য চলচ্চিত্রে নির্যাতিত; শোষিত-বঞ্চিত মানুষের ভূমিকাতে দেখা গেছে তাকে।
‘ভাইজান’ চলচ্চিত্রে নায়ক জসিম যখন বোন শাবানাকে তার সব সম্পত্তি লিখে দেন, তিনি সেটা খুব গর্ব করে বলতে গিয়ে কাঁদতে থাকেন। এই আবেগপূর্ণ অভিনয় দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ‘টাইগার’ চলচ্চিত্রে ব্যতিক্রমী চেহারায় ( লুক) ভিন্ন কিছু উপস্থাপন করেন তিনি। যা দর্শকের হাততালিতে সাফল্য পায়। ‘চিত্রা নদীর পারে’ চলচ্চিত্রে নাপিতের চরিত্রেও ব্যতিক্রম ছিলেন সৈয়দ আখতার আলী। এ ছাড়া ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’য় নবাবের প্রজার একজন হিসেবে নিজের অভিনয় দক্ষতার প্রমাণ রাখেন। ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’তেও এ অভিনেতাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন পরিচালক।
সৈয়দ আখতার আলীর অভিনয় জীবনের আফসোস ছিল-কোনো কালজয়ী কিংবা স্মরণীয় চরিত্র তিনি পাননি। অসংখ্য চলচ্চিত্রে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন মাত্র। কিন্তু নিপুণ দক্ষতায় তার অভিনীত চরিত্রগুলোকে সাবলীল করে তুলেছেন এ অভিনেতা। তিনি সবসময় অসহায়- বঞ্চিত-লাঞ্ছিত আর শোষণে জর্জরিত মানুষের প্রতিরূপ ছিলেন। চেহারা; শারীরিক গঠন ও অভিনয় দক্ষতার জন্য পরিচালকরাও তাকে এসব চরিত্রের জন্যই নির্বাচন করেছেন। আর তিনিও তার অভিনয় প্রতিভার গুণে চরিত্রকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলে দর্শকদের নজর কেড়েছেন। মনে রাখার মতো কোনো চরিত্রে অভিনয় না করেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের, ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন এ অভিনেতা। পর্দায় সারাজীবন গরিব থাকলেও দর্শকের হৃদয়ের বড় অংশ জয় করতে পেরেছেন।
টঙ্গীর বোর্ডবাজারের নিজ বাড়িতে বার্ধক্যজনিত কারণে ২০১৩ সালের ২২ জুলাই সৈয়দ আখতার আলীর মারা যান। ন্যাচারাল এ অভিনেতা পরিচালক হিসেবে নাম লিখিয়ে খল অভিনেতা জাম্বুকে নায়ক করে ‘নাবালক’ নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনায় হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি আর শেষ করতে পারেননি। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নিজের অভিনয় গুণে চিরভাস্বর থাকবেন সৈয়দ আখতার আলী।