আমাদের একটা ‘সুন্দরবন’ আছে। এই বন আমাদের অহঙ্কার। এটি বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা প্যারাবন। সুন্দরবনে একবার যার পা পড়েছে তাকে বারবার ডাকবে এর জীববৈচিত্র। নানা ধরনের বৃক্ষমালায় আচ্ছায়িত এই বনে রয়েছে বিশ্বসেরা বেঙ্গল টাইগারের পাশাপাশি চিত্রা হরিণের চকিত মায়াবি চাহনি আর নানা প্রজাতির পাখি। এই অপরূপ দৃশ্যই দেশী-বিদেশী পর্যটকদের সুন্দরবনে টানে।
সাম্প্রতিককালে সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটকদের আনাগোনা বহুলাংশে বেড়েছে। সেই সঙ্গে পাখি ও অন্যান্য প্রজাতির জীবজন্তুর নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়েছে। প্রজননকালে বনে পর্যটকদের অবিবেচক চলাফেরায় পাখির বংশবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক সময় কৌতূহল থেকে আবার অনেক সময় অজ্ঞাতার কারণে এটি ঘটছে। এ অবস্থায় কি করা উচিত তা বন বিভাগ এবং বিশেষজ্ঞদের উপর নির্ভর করে। সম্প্রতি সুন্দরবনের একটি অভিজ্ঞতা এখানে তুলে ধরছি।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সুযোগ পেলেই সুন্দরবনে দলবেঁধে ছুটে যাই। প্রতিটা ট্রিপেই অনেক স্মৃতি সেখানে আর খুঁজে পাই না। তাই ভয় হয় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র কি হারিয়ে যাচ্ছে!
প্রতিবারের মতো এবারও বনের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছি। অনেকটা হতাশ হয়েছি। সাধারণত আমরা পাখি এবং অন্যান্য প্রাণীর ছবি তুলতে সুন্দরবনে যাই। সংগ্রহের ভাণ্ডারে নতুন কিছু যোগ করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তবু সুন্দরবন এক ভালোবাসার জায়গ
আর কিছুদিন পর পর্যটকদের জন্য সুন্দরবন বন্ধ হয়ে যাবে। তার উপর সামনে রোজা। আমাদের টিম থেকে সিদ্ধান্ত হলো এর আগে একটি ট্রিপ দেয়ার। সে অনুযায়ী যাত্রা শুরু। বনের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত চষে বেড়ালাম। নাহ, হলো না। এখানে বলা ভালো আমরা যারা সুন্দরবনে ফটোগ্রাফি করতে যাই তাদের সবার মনে একটা সুপ্ত বাসনা থাকে। সেটা হচ্ছে সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণ ‘বেঙ্গল টাইগার’। আমাদেরও সে বাসনা ছিল। এটা অস্বীকার করার উপায় নাই। তবে সে বাসনা প্রবল ছিল না। কারণ গত ২০২২ সালের ৩১ মার্চ আমরা সুন্দরবন থেকে সেই বাঘের ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছি। সেটা এক বিরল প্রাপ্তি। খুব কম ফটোগ্রাফারের এমন সৌভাগ্য হয়।
বলছিলাম, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র কি হারিয়ে যাচ্ছে? এটা বের করা গবেষকদের কাজ। তবে এবারের ট্যুরে সাধারণ দৃষ্টিতে আমার মনে হয়েছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র হারাচ্ছে। আর এ জন্য দায়ি আমরা যারা সুন্দরবন সম্পর্কে না জেনে ভ্রমণ করি। যারা সুন্দরবনে যান তারা সুন্দরবনকে জানতে চান কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েছে। সুন্দরবনে বেশ কয়েকটি সমুদ্র সৈকত রয়েছে। সেগুলোতে গেলে বোঝা যায় মানুষের পরিবেশ বিধ্বংসী আচরণ। এমন কোন পরিত্যাক্ত জিনিস নেই যা সুমুদ্র সৈকতগুলোতে দেখা না যায়। প্লাস্টিকের বোতল, স্যান্ডেল, অ্যালুমুনিয়াম ফয়েলসহ নানা বর্জ্য স্তূপাকারে জমে আছে। দূষিত করে তুলছে পরিবেশ। বনের অনেক জায়গায় ডাস্টবিন আছে, সেগুলো বর্জ্যশূন্য। তবে তার পাশেই পড়ে আছে নানা ক্ষতিকর বর্জ্য।
নিয়ম অনুযায়ী পর্যটকদের সঙ্গে বন বিভাগের একজন করে ‘গানম্যান’ নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাদের সামনেই পর্যটকরা পানির বোতল, চিপসের ফয়েলসহ অন্যান্য বর্জ্য ফেলছেন। কিন্তু তাদের বাধা দেয়ার কাউকে দেখিনি। ফলে সুন্দরবনের পরিবেশ যে দিন দিন পাল্টাচ্ছে তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
এখানে আমার ভারতের রাজস্থানের ভরতপুর বার্ড সেঞ্চুরির একটি অভিজ্ঞতা না বললেই নয়। সেবার প্রথমবার দেশের বাইরে পাখির ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। সেখানে ছবি তোলার জন্য ফটোগ্রাফার বা পর্যটকরা সাইকেল বা রিকশা ব্যবহার করতে পারেন। আমার সঙ্গে ছিলেন প্রয়াত ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার ডা. নাজমুল হক। আমাদের যে রিকশাচালক বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি আমাদের গাইড হিসেবেও কাজ করছিলেন। চলার পথে হঠাৎ রিকশা থামিয়ে রিকশাচালক কিছু একটা তুলে পকেটে রেখে দিলেন। আমার কৌতূহল হলো। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী টোকালেন? বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে পকেটে রাখা জিনিসটা বের করে দেখালেন। সেটা ছিল চকলেটের একটি প্লাস্টিক ফয়েল। তিনি বললেন, এটা আমার সুপার দেখতে পারলে আমার চাকরি চলে যেতো। এরপর বিশাল এলাকা ঘুরে বিভিন্ন প্রজাতির ছবি তুললাম। কোথাও তিল পরিমাণ বর্জ্য দেখা মেলেনি। গেটে ঢোকার সময় অনেকগুলো নির্দেশনা ছিল। তার প্রতিটা মেনে চলতে বাধ্য করেছেন সেই রিকশাচালক। সেখানে যারা ঘুরতে যান তাদের মধ্যেও নিয়ম ভাঙ্গার প্রবণতা দেখিনি। আর আমাদের সুন্দরবন আমরা নিজেরাই নষ্ট করে ফেলছি।
যত্রতত্র বর্জ্য ফেলছি, গোলপাতা কাটার নামে গাছ কেটে বন উজাড় করছি, মাছ শিকারের জন্য পানিতে বিষ মেশাচ্ছি, সূক্ষ্ম জাল ব্যবহার করে মাছের পোনা নিধন করছি। পাখিদের প্রজননকালে নানা ধরনের বাঁধার সৃষ্টি করছি। চরে পাখিদের ডিম নষ্ট করছি।
এবারের ভ্রমণকালের একটি ঘটনা উল্লেখ করে লেখাটা শেষ করবো। বঙ্গোপসাগরের পাশেই জেগে ওঠা একটি চরের ঘটনা। ভোর থেকে বিভিন্ন খাল ঘুরে সমুদ্রের উপকূলে একটি চরে আমাদের নৌকা নোঙর করে। উত্তপ্ত বালুর উপর দিয়ে হাঁটা আমার শরীরে সইবে না বলে আমি নৌকাতেই অবস্থান করি। বাকিরা নেমে গেলেন উপকূলীয় বিভিন্ন পাখির ছবি তুলবেন বলে। তখন ওই চর জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। কেউ দৌড়াদৌড়ি করছেন, কেউবা সৈকতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে তপ্ত বালুচরে ফুটবল খেলা। এর মাঝে কয়েকজনকে দেখলাম গোলাকার কি যেন আগ্রহ নিয়ে দেখছেন। কেউ সেগুলো ফুটবলের মতো লাথি মারছেন। পায়ের আঘাতে সেগুলো বালিতে মিশে যাচ্ছে। তারা হাসিতে ফেটে পড়ছেন। আমার কেন জানি সন্দেহ হলো। কোনো ডিম নয়তো? কারণ এ সময় পাখিদের ডিম ফোটানোর কথা।
নৌকা থেকে নেমে গেলাম। গিয়ে যা দেখলাম দেখে আমি আকাশ থেকে পড়লাম! হ্যাঁ, সেগুলো পাখির ডিম ছিল। ইতোমধ্যে বেশ কিছু ডিম নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। যারা এই কাণ্ড করছিলেন তাদের মধ্যে কেমন যেন বন্য আচরণ দেখতে পেলাম। তারা আরো খুঁজে পেতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। অদূরেই বেশ কয়েক জোড়া থীক নি এবং অন্যান্য প্রজাতির পাখি দেখলাম। হয়তো ডিমগুলো ওই পাখিগুলোর হবে। কয়েকজন পর্যটককে ডেকে তাদের বোঝালাম, তারা কৃতকর্মের জন্য দুঃখপ্রকাশ করলেন। সেই সঙ্গে একাজ থেকে বিরত থাকার প্রতিজ্ঞা করে বললেন, আমরা চিনতে পারিনি। ভুল করে ফেলেছি।
পাখিদের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোরে ক্ষেত্রে সুন্দরবনে পর্যটকদের বেসামাল আনাগোনা পাখির বংশ বিস্তারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ফলে পরিবেশ ভারসাম্য হারাতে বসেছে। এ অবস্থায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন দেশের প্রখ্যাত দুই ফটোগ্রাফার।
এ বিষয়ে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার ফরিদী নুমান বলেন, পর্যটকদের সুন্দরবনে যাতাযাতে বিধিনিষেধ আরোপ করে সমস্যা সমাধান করা সম্ভব কিনা সেটা দেখার বিষয়। প্রাকৃতিকভাবেই নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বংশ বিস্তার করে। শুধু পর্যটক নয়, পাখিদের ডিম ঈগলের থাবায়ও নষ্ট হয়। তবে পর্যটকরা যাতে পাখির ডিম নষ্ট না করে সে বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এ বিষয়ে বন বিভাগকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া গণমাধ্যমগুলোও সচেতনা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
বহুবার সুন্দরবন ভ্রমণকারী ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার আদনান আজাদ বলেন, ইন্ডিনয়ান থিক নি, টার্ন, ইউরেশিয়ান কার্লিউ, প্লোভারেরা এই সিজনে উত্তপ্ত বালিতে ডিম পেড়ে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটায়। সাধারণত শীতের পরে ও বর্ষার আগের সময় বৃষ্টি থাকে না। তাই প্রজননের জন্য এই সময়টিকেই তারা বেছে নেয়। এদের ডিমের রঙ নুড়ি পাথরের মতো, চলতি পথে তা দেখা যায় না, বালুর রঙের সাথে মিলিয়ে থাকে। তাই পর্যটকদের পায়ের নিচে পড়ে ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। যেহেতু এটি একটি পর্যটন এলাকা, তাই বন অধিদপ্তরের উচিত এই পাখিগুলো নির্দিষ্ট যে এলাকাতে প্রজনন করে তা চিহ্নিত করে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া। না হলে পাখিদের বংশ বিস্তার বাধাগ্রস্তহ হবে, পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে।