• বৃহস্পতিবার ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪
logo

বাশার আল-আসাদের পতনে ক্ষতিগ্রস্ত ইরান ও রাশিয়া

আন্তর্জাতিক ডেস্ক ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১০:১৪ এএম

সিরিয়ার যুদ্ধে পরাশক্তি দেশগুলো জড়িয়ে পড়ার ফলে বাশার আল–আসাদ সরকারের পতনের পরে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের একটি পরিবর্তন এখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অভিযানে বিদ্রোহীরা রাজধানী দামেস্কে ঢুকে পড়লে গত রোববার বাশার আল–আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন রাশিয়ায়। এর মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটেছে। সেই সাথে মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক ইতিহাসে নৃশংস এক স্বৈরাচারী সরকারের পতন ও দেশটিতে ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধের ইতি ঘটেছে।

২০১১ সালে অন্যান্য দেশের মতো সিরিয়াতেও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হলে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বাশার আল–আসাদ বিক্ষোভকারীদের ওপরে ভয়াবহ নৃশংসতা চালান। এখন পর্যন্ত তাঁর অত্যাচারে পাঁচ লক্ষাধিক সিরীয় প্রাণ হারিয়েছেন। এবং উদ্বাস্তু হয়েছেন দেড় কোটি। 

বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়লে সিরিয়ার এ গৃহযুদ্ধ আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করে। সিরিয়ার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল পরাশক্তি দেশগুলো। ফলে বাশার আল–আসাদ সরকারের পতনের পরে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের একটি পরিবর্তন এখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

১৯৪৪ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সিরিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হয়। এর এক দশক পর সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে অস্ত্র কেনে সিরিয়া। এরপর গত শতকের সত্তরের দশকে মিসরের মতো অন্য আরব দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মুখ ফেরালেও বাশার আল–আসাদের বাবা হাফিজ আল–আসাদ সরকার সোভিয়েতের ঘনিষ্ঠ মিত্র থেকে যান।

২০০৪ সালে প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে মস্কো যান বাশার আল–আসাদ। এ সফরের লক্ষ্য ছিল স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত করার পাশাপাশি সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে আধুনিক করতে রাশিয়ার সহায়তা চাওয়া।

অন্যদিকে, সিরিয়া ও ইরানের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও কয়েক দশকের পুরোনো। ১৯৭৯ সালে দুই দেশ স্থায়ী জোট গঠন করে। সিরিয়া ও ইরানের জোটবদ্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে কাজ করেছিল ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে উভয় দেশের বৈরী সম্পর্ক। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে আক্রমণ চালালে দুই দেশের আরও কাছাকাছি আসে।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসনে ইরাকে ধ্বংসযজ্ঞ ও ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধ ইরানের জন্য অশীর্বাদ হয়ে আসে। আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল থেকে ভূমধ্যসাগরের তীর পর্যন্ত শিয়া–অধ্যুষিত এলাকাগুলো ইরান–সমর্থিত শিয়া গোষ্ঠীগুলো ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে। 

২০১১ সালে  সিরিয়ায় আরব বসন্ত শুরু হলে মিত্র বাশার আল–আসাদের সমর্থনে তৎপর হয়ে ওঠে ইরান। তেহরানের ভাষ্য, সিরিয়ায় সরকারবিরোধী এ বিক্ষোভের নেপথ্যে কাজ করেছে তুরস্ক ও কিছু আরব দেশ। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব খর্ব করাই ছিল এর লক্ষ্য। সিরিয়ার সরকারি বাহিনী ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে বাশার আল–আসাদের পক্ষে যুদ্ধ করতে হিজবুল্লাহসহ ইরানপন্থী যোদ্ধাদের সিরিয়া পাঠায় তেহরান।

শুধু সামরিক সহায়তাই নয়, বাশার আল–আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে শত শত কোটি ডলার আর্থিক সাহায্য ও ঋণ দিয়ে এসেছে ইরান। কিন্তু এরপরও ২০১৫ সালে এসে বাশার আল–আসাদের সরকার প্রায় পতনই হতে যাচ্ছিল। এই সময়ে ইরান কয়েক শ মাইল ছুটে যায় তার আরেক মিত্র রাশিয়ার কাছে। একই বছর সিরিয়ার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে রাশিয়া।

রাশিয়ার মতো পরাশক্তি ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক ও আরব দেশগুলোর সমর্থন পেয়ে আসা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে দমন করতে পারছিল না সিরিয়ার সরকারি বাহিনী। এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক ও কূটনৈতিক অবস্থান আরও দৃঢ় করার সুযোগ পায় রাশিয়া। এতে আরব বিশ্বে রাশিয়াও যে ক্ষমতাধর, সেটাও দেখানোর সুযোগ পায় মস্কো। 

যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বিদ্রোহীদের দিক থেকে অনেকটা মুখ ফিরিয়ে নিলে তাদের একমাত্র সমর্থক দেশ হিসেবে রয়ে যায় তুরস্ক। এর পর থেকে তুরস্ক অবশ্য সংঘাতের রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষেও অবস্থান নিয়েছিল। আলোচনার মাধ্যমে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থামাতে ২০১৭ সালে কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় একটি প্রস্তাব দেয় রাশিয়া। সেই প্রস্তাবে তুরস্ক সমর্থন দেওয়ার কথা জানিয়েছিল।

এর পরের কয়েক বছরে মিত্র রাশিয়া ও ইরানের সহায়তায় বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে জোর তৎপরতা চালান বাশার আল–আসাদ। এ সময় বিভিন্ন স্থানে সংঘাতে না জড়ানোর চুক্তি ও যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেন বাশার। এই তো কিছুদিন আগেও মনে হচ্ছিল মিত্র বাশার আল–আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার পাকাপাকি বন্দোবস্ত করার ক্ষেত্রে সফল হয়েছে রাশিয়া ও ইরান। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থানও সংহত করেছে। দামেস্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে শুরু করেছিল আরব ও ইউরোপের দেশগুলো। কিন্তু বিদ্রোহীদের ১২ দিনের ঝটিকা অভিযানে সব মিথ্যা হয়ে গেল।

সূত্র: আল জাজিরা