দেশে চলমান অস্থিরতার মধ্যেও ঘুরে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অন্তবর্তীকালীন সরকার। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের পাশাপাশি হুহু করে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বর্তমানে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার।
এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নেমে আসবে। এ জন্য কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণসহ অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক তুলে দেওয়া হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) রাতে রাজধানীর একটি হোটেলে ব্রোকারেজ হাউস ব্র্যাক ইপিএল এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটাল পার্টনার্সের আয়োজনে বিনিয়োগকারী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। আলোচনায় অংশ নেন অর্থনীতিবিদ ড. মাসরুর রিয়াজ, অধ্যাপক মোস্তাক হোসেন খান, ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন, ডিএসইর ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম। সঞ্চালনা করেন এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটালের চেয়ারম্যান ইফতি ইসলাম। অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা অংশগ্রহণ করেন।
সরকার এখন যেসব সমস্যা মোকাবিলা করছে, তার সবই উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বলে মন্তব্য করেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, এখনকার বড় সমস্যা মূল্যস্ফীতি। একে বাগে আনতে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে যা কিছু করার ছিল, তার সবটাই করা হয়েছে। তার পরও হতাশা আছে, মুদ্রাস্ফীতি এখনও নামছে না। মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতি যথেষ্ট কঠোর করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ছাপিয়ে একটি টাকাও দেয়নি। লাগলে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। সরকারও ব্যয় কমিয়েছে, বাজেটের অভ্যন্তরীণ ঋণকে যুক্তিসংগত স্তরে রাখার চেষ্টা করছে।
গভর্নর বলেন, পণ্য সরবরাহে ঘাটতি একটা বড় সমস্যা হয়ে আছে। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে বন্যা হয়েছিল, বর্ষাকালও দীর্ঘ ছিল। এ কারণে, পেঁয়াজ, আলুর মতো ফসল এবং শীতকালীন শাকসবজি স্বাভাবিক সময়ের মধ্যে বাজারে আসতে পারেনি। এক থেকে দুই মাস বিলম্বিত হয়েছে। পেঁয়াজ ও আলুর ভালো ফলন হবে এবং দুই মাস বাদে ৩০ টাকা, ৪০ টাকায় নেমে আসবে বলে আশা করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘সরবরাহ ঠিক করতে সরকার অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্যের সব ধরনের আমদানি শুল্ক তুলে দিয়েছে। পেঁয়াজ, তেল, চিনি, মৌলিক খাদ্য পণ্যের দাম ভোক্তাদের জন্য একটু সহনীয় করতে যা করতে পারি, তার কিছুই বাকি রাখিনি। আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে কিছু ফলাফল আশা করছি। এখন নীতি সুদহার ১০ শতাংশ এবং এবং ঋণের সুদহার প্রায় ১৪ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। সম্ভবত এটা সর্বোচ্চ। জানুয়ারির মধ্যে যদি দেখি মুদ্রাস্ফীতি কমেনি, আমাকে আরও কঠোর আর্থিক নীতি নিতে হবে।’ প্রসংগত মুদ্রনীতি কঠোর করার অর্থই হচ্ছে নীতি সুদহার আরও বাড়বে। আর নীতি সুদহার বাড়ার প্রভাবে ব্যাংক ঋণের সুদের হারও বাড়ে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য জুনের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং আগামী অর্থবছরে ৫ শতাংশের কমে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশ থেকে যে শিক্ষাটি আমরা পেয়েছি, তা হলো, এটি ঠিক করতে কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে। সে সময় দিতে হবে। এ জন্য যেসব ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে, তা প্রয়োগ করা হয়েছে। আমরা এখন ফলের জন্য অপেক্ষা করছি।’
গভর্নর বলেন, ‘একটাও এলসি বিল অপরিশোধিত রাখা সহ্য করব না। ব্যাংকগুলোকে স্পষ্ট করে বলেছি, এলসি খোলা হলে সে এস আলম বা অন্য যেই খুলুক না কেন, এটা ব্যাংকের দায়। ব্যাংককেই তা নিষ্পত্তি করতে হবে। যেসব বিল এখনও বকেয়া আছে, আমি আশাবাদী, এক মাসের মধ্যে এটি শূন্য হয়ে যাবে।’
অধ্যাপক মোস্তাক হোসেন খান বলেন, দুর্নীতির প্রধান কারণ সুশাসনের অভাব। বিগত সরকারের সময় দুর্নীতি মাত্রা ছাড়িয়েছিল। ব্যবসায়িক ফোরামগুলোও রাজনীতিকীকরণ হয়েছিল। রাজনৈতিক সংযোগ না থাকলে কেউ প্রতিযোগিতায় ব্যবসা পাওয়ার আশা করত না।
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, গত ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর অনেকের মনে শঙ্কা ছিল, এই বুঝি দেশ অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে। আশার কথা, তেমনটি হয়নি। এখন প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স আসছে। কিছু ব্যাংক সমস্যায় থাকলেও অনেক ব্যাংক আছে, যাদের কোনো তারল্য সংকট নেই।