জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাককে বাংলার সক্রেটিস হিসেবে গণ্য করা হয়। তার রচিত তেমন কোনো বই না থাকলেও তিনি বুদ্ধিজীবীদের গুরু। তার যোগ্য শিষ্য আহমদ ছফা ও সলিমুল্লাহ খান। চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানে সলিমুল্লাহ খানের ভূমিকা সবাই জানেন। শুধু তাই নয়, আবদুর রাজ্জাকের চিন্তা এতটাই প্রসারিত যে এখনকার তরুণ বুদ্ধিজীবিরাও তার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন একজন দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর এবং ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক সক্রেটিসের ন্যায় সারাটা জীবন অতিবাহিত করেছেন জ্ঞানার্জনে। কিংবদন্তিতূল্য জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনিসের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক খুশবন্ত শিং। জ্ঞানের সমুদ্রে ডুবে ছিলেন চিরকাল। যার কাছে জগত-সংসার ছিলো গৌণ আর জ্ঞানার্জনটা ছিলো মুখ্য। যিনি ছিলেন শিক্ষকদেরও শিক্ষক। এমনই ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক। যাকে পরবর্তীতে ‘জ্ঞানতাপস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর পাস করেন। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে এ বিভাগ থেকে অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান দুটি পৃথক বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন। পদোন্নতির আবেদন করতেন না বিধায় তিনি দীর্ঘকাল জ্যেষ্ঠ প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দিলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন।
তিনি লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে বিখ্যাত অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কির অধীনে পিএইচডি করার জন্যে লন্ডন গমন করেন, তার পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিলো ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুর রাজ্জাক গবেষণা সন্দর্ভ জমা দেয়ার আগেই প্রফেসর লাস্কির মৃত্যু হয়। লাস্কির মতো শিক্ষকের মৃত্যুতে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক প্রচণ্ড মর্মাহত হন ও গবেষণাকর্মে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আব্দুর রাজ্জাক থিসিস জমা না দিয়েই দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীতে ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে যোগ দেয়ার আহ্বান জানায়।
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পিএইচডি দেয়। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে মনোনীত করে। তার জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত ছিলো বিশেষত প্রাশ্চ্যতত্ত্ব, ইতিহাস ও রাজনীতিতে।
প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক বেশিরভাগ মানুষের কাছেই দুর্ভেদ্য এবং রহস্যময়, কেননা জীবদ্দশায় যে পরিমাণ জ্ঞান আহরণ করেছেন, তার সিকিভাগও তিনি লিখে রেখে যাননি, যার জন্য তার দর্শন, মতবাদ, চিন্তাচেতনা কিংবা পাণ্ডিত্যের রেশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কেবলমাত্র তার শিক্ষকতা এবং শিক্ষকতা পরবর্তী সময়ে যারা তার সান্নিধ্য লাভ করেছেন তারাই জানেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন, প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক কতটা মহান ব্যক্তি এবং জ্ঞানী দার্শনিক ছিলেন।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক চল্লিশ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জ্ঞান আর নিজেকে সকলের স্তরে। তাকে বলা হতো শিক্ষকদের শিক্ষক।
জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক, যিনি জ্ঞানের বাতিঘর হয়েও জীবদ্দশায় কোনো বই লিখেননি। আহমদ ছফার মাধ্যমেই আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে বিস্তর জানা যায়। বাংলাদেশে ‘বাঙালি মুসলমান’ কনসেপ্টটি মূলত অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মাধ্যমেই পরিপূর্ণভাবে ফুটে ওঠে।
সততা, শুদ্ধতা আর জ্ঞানার্জনের তৃষ্ণায় কাতর যে জীবন আব্দুর রাজ্জাক যাপন করেছেন, তা প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের জীবনী আমাদের জন্য নিরন্তর প্রেরণার উৎস।