‘শুয়া চান পাখি আমার, আমি ডাকিতাছি, তুমি ঘুমাইছো নাকি’ এই বিরহ ব্যথার গানটি শুনেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমাদের কানে গানটি ধ্বনিত হতেই প্রিয়তম মানুষের জন্য বুকটা হাহাকার করে উঠে। এই গানের শিল্পী বারী সিদ্দিকীও ২০১৭ সালের আজকের দিনে কোটি ভক্তের বুকে হাহাকার তুলে পাড়ি জমিয়েছেন পরলোকে। বারী সিদ্দিকীর প্রয়াণ দিবসে টিএন২৪ এর কীর্তিমান বিভাগ স্মরণ করছে এই গুণী শিল্পীকে।
বাঁশি বাজিয়ে শুরু করেছিলেন সঙ্গীত জীবন। তারপর কণ্ঠে তুলে নেন গান। ভিন্ন ধারার গান গেয়ে পেয়ে গেলেন তুমুল জনপ্রিয়তা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভিন্ন ধারার গান গেয়ে নিজের স্বাতন্ত্র্য তৈরি করতে পেরেছিলেন বারী সিদ্দিকী। গানকে করে তুলেছিলেন সংবেদনশীল। সুরে সুরে শ্রোতাদের হৃদয়ে অদ্ভুত এক আবেগ ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন এই শিল্পী। আর তাই বারী সিদ্দিকী কে ভালোবেসেছিল আপামর জনতা।
জেনে নেয়া যাক, এই কিংবদন্তির আদ্যোপান্ত:
তার পুরো নাম আবদুল বারী সিদ্দিকী। ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর নেত্রকোনার এক সঙ্গীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শৈশবে পরিবারের কাছে গান শেখার হাতেখড়ি। মাত্র ১২ বছর বয়সেই নেত্রকোনার শিল্পী ওস্তাদ গোপাল দত্তের অধীনে তার আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তিনি ওস্তাদ আমিনুর রহমান, দবির খান, পান্নালাল ঘোষসহ অসংখ্য গুণী শিল্পীর সরাসরি সান্নিধ্য লাভ করেন।
ওস্তাদ আমিনুর রহমান একটি অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সময় বারি সিদ্দিকীকে দেখে আরও প্রশিক্ষণ নেয়ার প্রস্তাব দেন। এরপর, ছয় বছর ওস্তাদ আমিনুর রহমানের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। সত্তরের দশকে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত হন বারী।
এরপর, ওস্তাদ গোপাল দত্তের পরামর্শে ধ্রুপদী সংগীতে পড়াশোনা শুরু করেন বারী সিদ্দিকী। পরবর্তী সময়ে বাঁশির প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠায় তিনি বাঁশির ওপর উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রশিক্ষণ নেন। নব্বইয়ের দশকে ভারতের পুনে গিয়ে পণ্ডিত ভিজি কার্নাডের কাছে তালিম নেন। দেশে ফিরে লোকগীতির সঙ্গে ধ্রুপদী সংগীতের সম্মিলনে গান গাওয়া শুরু করেন।
নব্বইয়ের দশকে কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে বারী সিদ্দিকীর পরিচয়। হুমায়ূনের নাটক-সিনেমায় গান করায় বারীর পরিচয় আরও ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেন তিনি।
১৯৯৫ সালে হুমায়ূন আহমেদের ‘রঙের বাড়ই’ নামের একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে প্রথম সংগীত পরিবেশন করেন বারী সিদ্দিকী। এরপর, ১৯৯৯ সালে হুমায়ূন আহমেদের রচনা ও পরিচালনায় ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে সাতটি গানে কণ্ঠ দেন তিনি। এর মধ্যে ‘শুয়া চান পাখি’ গানটির জন্য তার পরিচয় ও শ্রোতাপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। তারপর, আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
১৯৯৯ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাঁশি সম্মেলনে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগদান করেন তিনি। বারী সিদ্দিকী বাংলাদেশ টেলিভিশনে সংগীত পরিচালক ও মুখ্য বাদ্যযন্ত্রশিল্পী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
বারী সিদ্দিকীর জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে আছে- শুয়া চান পাখি আমার, পূবালি বাতাসে, আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, ওলো ভাবিজান নাউ বাওয়া, মানুষ ধরো মানুষ ভজো, রজনী হইস না অবসান, তুমি থাকো কারাগারে, সাড়ে তিন হাত কবর, ঘরেও জ্বালা বাইরেও জ্বালা, ‘আমার মন্দ স্বভাব জেনেও, মরার আগে মনটা মরে গেলো, এই পৃথিবী যেমন আছে, মাটির দেহ, অপরাধী হলেও আমি তোর, একটু মাটি দেনা, বড় বেশি মন্দ আমি, মনের দুঃখ মনেই রইলো, তুমি না থাকলে, মনটা যদি টাকার মতো, পাপি আমি, মাটির দেহ ক্ষয় করিলাম প্রভৃতি ।
তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা, উইকিপিডিয়া